লন্ডনের মুরফিল্ডস আই হসপিটালে একদল দৃষ্টিহীন রোগীর চোখে অত্যাধুনিক একটি ইমপ্লান্ট সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে তারা এখন আবার বিভিন্ন ধরণের দৃশ্য দেখে এবং সাধারণ কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন। চিকিৎসকদের দাবি, এই আন্তর্জাতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল অত্যন্ত উৎসাহজনক এবং প্রত্যাশার বেশি।
সত্তর বছরের দৃষ্টিহীন রোগী শিলা আরভিন এই প্রযুক্তির সাহায্যে আবার বই পড়া, ক্রসওয়ার্ডের মতো খেলার সেতুবন্ধন করতে পারছেন। তিনি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই অভিজ্ঞতাকে তিনি ছিল একেবারেই অন্যরকম এবং অবিশ্বাস্য।
বিশেষ করে ‘ড্রাই এজ-রিলেটেড ম্যাকুলার ডিজেনারেশন’ নামে পরিচিত চোখের জটিল এই রোগের জন্য এই প্রযুক্তি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এটি মূলত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এই রোগে রেটিনার ক্ষুদ্র কোষগুলো ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মরতে শুরু করে, ফলে দৃষ্টি ঝাপসা বা বিকৃত হয়ে যায়।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন, এর মধ্যে শুধু যুক্তরাজ্যেই আড়াই লাখেরও বেশি।
ক্যালিফোর্নিয়ার ভিত্তিতে একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানি, সায়েন্স করপোরেশনের তৈরি ‘প্রিমা ইমপ্লান্ট’ নামের এই মাইক্রোচিপটি এই সাফল্যের মূল ভিত্তি। এটি এরকমভাবে কাজ করে:
ইমপ্লান্ট স্থাপন: সফল একটি অস্ত্রোপচারের মধ্যে দিয়ে মানুষের মাথার চুলের মতো পাতলা, দুই মিলিমিটার আয়তনের একটি ফটোভোলটাইক মাইক্রোচিপ রেটিনার নিচে স্থাপন করা হয়।
ছবি গ্রহণ: রোগীরা পরে বিশেষ ধরনের চশমা পরেন, যার মধ্যে ইনক্লুডেড থাকে একটি শক্তিশালী ভিডিও ক্যামেরা।
মস্তিষ্কে তথ্য পাঠানো: এই ক্যামেরা ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে ভিডিও চিত্র ইমপ্লান্টে পাঠায়। ইমপ্লান্ট সেই তথ্যকে ছোট একটি প্রসেসরে পাঠায়, যেখানে ছবিটির আরও স্পষ্টতা আনা হয়। এরপর এই উন্নত ছবিটি ইমপ্লান্ট এবং অপটিক নার্ভের মাধ্যমে রোগীর মস্তিষ্কে ফিরে যায়, যা দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।
মুরফিল্ডস আই হসপিটালের কনসালট্যান্ট ও অপথ্যালমিক সার্জন ড. মাহি মুকিত বলেন, ‘এটি প্রথম ইমপ্লান্ট যা দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তারা এখন বই পড়া, লেখা ও সাধারণ দৃশ্য দেখার মতো কাজগুলো করতে পারছেন। এটি আমাদের জন্য এক বড় অগ্রগতি।’
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, ইউরোপের পাঁচটি দেশের মোট ৩৮ জন রোগী এই প্রিমা ইমপ্লান্ট ট্রায়ালে অংশ নেন। এর মধ্যে ৩২ জনের চোখে ইমপ্লান্ট বসানো হয়, এবং তাদের মধ্যে ২৭ জন এখন পড়তে সক্ষম। এক বছর পেরোনোর পর তাদের দৃষ্টিশক্তির আরও উন্নতি হয়েছে।
উইল্টশায়ারের বাসিন্দা শিলা আরভিন, যিনি প্রায় ৩০ বছর আগে দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করেছিলেন, তিনি বলেন, ‘ইমপ্লান্ট বসানোর পর আমি আবার বই পড়তে ও সুডোকু খেলতে পারছি। আমি সত্যিই খুব খুশি। প্রযুক্তি দ্রুত উন্নয়ন করছে, আমি এর অংশ হয়ে অনেক আনন্দিত।’
ড. মুকিত ভবিষ্যৎ আশা প্রকাশ করেন, এই প্রযুক্তি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যের পরিষেবা (এনএইচএস)-এ ব্যবহার শুরু হবে। ড. পিটার ব্লুমফিল্ড, মাকুলার সোসাইটির গবেষণা পরিচালক, এই ফলাফলকে ‘উৎসাহজনক’ বলে মনে করেন এবং এই ধরনের অপ্রতিরোধ্য রোগের জন্য এটি একটি দারুণ খবর বলে অভিহিত করেন।
তবে, যাদের চোখের অপটিক নার্ভ ঠিকমতো কাজ করে না বা সংকেত পাঠাতে সক্ষম নয়, তাদের জন্য এই প্রযুক্তি কার্যকর নয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
Leave a Reply