চলমান ১৩৫২ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরাজ করছে এক রকম স্থবিরতা। আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতিসহ নানা কারণে সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন এবং বৈদেশিক অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে। ফলে কর্মসংস্থান, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, অর্থপ্রবাহের স্বাভাবিক গতি এবং প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। পাশাপাশি প্রকল্পগুলোতে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বলতে গেলে এডিপিভুক্ত সব প্রকল্পেই স্থবিরতা আছে। এর মূল কারণ হলো-চাহিদামতো অর্থছাড় না হওয়া। এখন কোন প্রকল্প প্রয়োজনীয় বা কোন প্রকল্প রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়েছিল সেগুলোর যাচাই-বাছাই না করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। সরকার এখন সার্বিক অর্থনীতির দিকটি নিয়ে ভাবছে। কেননা ব্যাংক খাতসহ অতীতে অর্থনীতির অনেক খাতই ফাঁকা হয়ে গেছে। সেসব ঠিক করাটাও জরুরি। পাশাপাশি উন্নয়ন বাজেটে যে বিশাল বরাদ্দ দেওয়া আছে সেদিকেও নজর দিতে হবে। আমি এ বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলব। এরপরই আপনাদের বিস্তারিত বলতে পারব।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর স্থবির অবস্থা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। এ সময় এ নিয়ে কিছু আলোচনাও হয়। বলা হয়েছে বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভেবে দেখছে। দ্রুত একটা সমাধান আসবে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ফলে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজই এগোচ্ছে না। এছাড়া চলতি অর্থবছরে অনুমোদন পাওয়া নতুন প্রকল্পগুলোতেও বরাদ্দ মিলছে না। পাশাপাশি চলমান অন্যান্য প্রকল্পেও আছে ধীরগতি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে খাতভিত্তিক দেখা যায়, সাধারণ সরকারি সেবা খাতে মোট ৩৫টি প্রকল্পটি রয়েছে। এছাড়া প্রতিরক্ষায় ১২টি, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষায় ২৭টি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৬৮টি, কৃষিতে ১৩৫টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ৯৪, পরিবহণ ও যোগাযোগে ২২৮টি এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১০২টি প্রকল্প রয়েছে। আরও আছে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১৩৯টি, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলিতে ২৬৬, স্বাস্থ্যে ৬৩, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদনে ৫৭, শিক্ষায় ১১৯, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ৫৪টি এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৫৫টি প্রকল্প রয়েছে। পাশাপাশি সমীক্ষা, কারিগরি সহায়তা এবং স্ব-অর্থায়নের প্রকল্পও রয়েছে। এডিপিতে এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া আছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।
আইএমইডি সূত্র জানায়, এডিপিতে এই বিশাল অঙ্কের বিপরীতে খরচের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ১৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। কিন্তু গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচ ছিল ২০ হাজার ৬১০ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের তিন মাসে খরচ হয়েছিল ২১ হাজার ৮৯৬ কোটি বা ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয় ১৯ হাজার ৫৫৯ কোটি বা ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। এমনকি করোনা মহামারির সময় ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে খরচ হয়েছিল ১৭ হাজার ৩০১ কোটি টাকা, যা যা মোট এডিপির ৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। আইএমইডির অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও ১ শতাংশের নিচে খরচ হয়েছে ২০০টি প্রকল্পের বরাদ্দ। এছাড়া ১-এর ওপরে কিন্তু ৩ শতাংশের মধ্যে খরচ হয়েছে ২১৯টি প্রকল্পের বরাদ্দ এবং ৩-এর ওপরে ৫ শতাংশের মধ্যে খরচ হয়েছে ২৪৩টি প্রকল্পের বরাদ্দ।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশিদ যুগান্তরকে বলেন, প্রথম তিন মাসে যে অবস্থা বিরাজ করছে এর প্রভাব আগামীতে আরও অবস্থা খারাপ হবে। কেননা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে গিয়ে বেশ ঝামেলার সৃষ্টি হবে। শেষ পর্যন্ত মেয়াদ ও সঙ্গত কারণেই ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হবে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীরা অনেকেই নীতিগতভাবে অর্থছাড় করছে না। তারা পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের অনুকূল পরিবেশ না পেলে এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে। ফলে এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ডলারের জোগানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমি যেটুকু জানি সড়কের অনেক প্রকল্পে আগে টেন্ডার হয়েছিল। কিন্তু পরে সেগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ফলে এখন রিটেন্ডার করতে হচ্ছে। এতেও বেশ সময় চলে যাচ্ছে। তবে একটি প্রকল্পের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত থাকে। কর্মসংস্থান, বিভিন্ন ম্যাটেরিয়ালস ইত্যাদি। সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন এই সরকারের উচিত দ্রুত প্রকল্পগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করে দেওয়া। এতে নেতিবাচক পরিস্থিতির কিছুটা অবসান ঘটবে।
এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন কম হওয়ায় চলতি অর্থবছরের অর্থছাড়ে করুণ চিত্র বিরাজ করছে। গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার। এর মথ্যে ঋণ থেকে ৬৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এবং অনুদান থেকে ছাড় করেছে ১৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার। কিন্তু গত অর্থবছরের তিন মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছিল ১২৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণ ১২৩ কোটি ১২ লাখ এবং অনুদান থেকে ছাড় করে ৫ কোটি ৫ লাখ ডলার। সেই সঙ্গে নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিতেও বিরাজ করছে দুরবস্থা। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে নতুন ঋণ অনুদানের প্রতিশ্রুতি এসেছে ২ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। কিন্তু গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল ২৮৮ কোটি ৫ লাখ ডলার। প্রতিশ্রুতির অর্থ হলো যখন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর হয় তখনই সেটি প্রতিশ্রুতি হিসাবে ধরা হয়ে থাকে।
Leave a Reply