আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দেশের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন, তখন তার বিরুদ্ধে কোনো ফেডেরাল ফৌজদারি অভিযোগ থাকবে না।
ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের ডিসট্রিক্ট জাজ তানিয়া চুটকান ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বেআইনিভাবে পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ সোমবার (২৫ নভেম্বর) দ্রুত বাতিল করে দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ আদালতে পেশ করা এক ফাইলিং-এ স্বীকার করেন, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট বা বিচার মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘস্থায়ী রীতি অনুযায়ী তারা ক্ষমতাসীন কোন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে না।
আদালতে আরেকটি ফাইলিং-এ স্মিথ একটি অপেক্ষামান আপিল থেকে ট্রাম্পের নাম সরিয়ে ফেলার জন্য আটলান্টার আপিল আদালতকে অনুরোধ করেন।
ট্রাম্প ২০২১ সালে তার মেয়াদ শেষে হোয়াইট হাউস থেকে যাবার পর তিনি শত শত রাষ্ট্রীয় গোপনীয় দলিল ফ্লোরিডায় তার বাসভবনে জড়ো করে রেখেছিলেন বলে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেই মামালা ফ্লোরিডার এক বিচারক বাতিল করেছিলেন। স্মিথ সেই মামলা পুনরায় চালু করার লক্ষ্যে আপিল করেছিলেন।
প্রসিকিউটর বলেন, দুটি মামলার গুনগত মান এবং ন্যায্যতা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই, যদিও তিনি বলছেন অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে।
ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে ঘোষণা দেন, ‘আমাকে অন্য যেসব মামলার মুখোমুখি হতে বাধ্য করা হয়েছে, সেগুলুর মত এই মামলাগুলোও বেআইনি এবং শূন্য, এগুলো কখনোই আদালতে আনা উচিত ছিল না’।
তিনি বলেন, করদাতাদের ১০ কোটি ডলার নষ্ট করা হয়েছে ডেমোক্র্যাট পার্টির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং আমার বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য। এটা ছিল একটি রাজনৈতিক ছিনতাই, এবং আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময়, তারপরও আমি টিকে আছি শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, এবং জিতেছি।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি যদি জয়ী হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ‘দু সেকেন্ডের মধ্যেই’ জ্যাক স্মিথকে বরখাস্ত করবেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের আগেই স্মিথ জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট থেকে চলে যাবার পরিকল্পনা করছিলেন।
ওয়াশিংটনের মামলায়, রিপাবলিকান দলের প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে যখন দেখা যায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন তাকে পরাজিত করেছে, তখন তিনি রাজ্য কর্মকর্তাদের ওপর চাপ দিয়েছিলেন ফলাফল পাল্টে দিতে।
প্রসিকিউটররা জাজ চুটকানকে অনুরোধ করেন মামলা ‘উইদাউট প্রেজুডিস’ বাতিল করতে, যার ফলে ২০২৯ সালে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবার পর অভিযোগগুলো তার বিরুদ্ধে পুনর্জীবিত করার রাস্তা খোলা থাকবে।
ট্রাম্পের বড় আইনগত বিজয়
এর আগে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, মামলা পরিচালনাকারি স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ-এর পক্ষে কাজ করা প্রসিকিউটরদের এই পদক্ষেপ রিপাবলিকান দলের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের জন্য বড় এক আইনগত বিজয়। ট্রাম্প ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং ২০ জানুয়ারি তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করবেন।
জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের যে নীতির কথা প্রসিকিউটররা বলেছেন, সেটা ১৯৭০-এর দশক থেকে অনুসরণ করা হচ্ছে। এই নীতির সারমর্ম হচ্ছে, একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে বিচারের মুখে দাঁড় করালে তা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লঙ্ঘন করা হবে, কারণ এর ফলে তিনি দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
নির্বাচন বানচাল করার অভিযোগ সংক্রান্ত মামলা তুলে নেওয়ার অনুরোধে প্রসিকিউটররা বলেন, ডিপার্টমেন্টের নীতি অনুযায়ী, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার আগেই মামলা বাতিল করতে হবে।
প্রসিকিউটররা মামলা বাতিলের অনুরোধ করে ফাইলে লেখেন, এই ফলাফল অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আনা মামলার গুনগত মান বা মামলার ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করে হয়নি।
গোপনীয় দলিল মামলা
একইভাবে, স্মিথের দফতর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হবার পর বেআইনিভাবে গোপনীয় দলিল রেখে দেওয়ার মামলা পুনরায় চালু করার প্রচেষ্টার সমাপ্তি টানার পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে প্রসিকিউটররা ইঙ্গিত দেন, তারা একটি ফেডেরাল আপিল কোর্টে অনুরোধ করবে, গোপনীয় দলিল নিয়ে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগে ট্রাম্পের দুজন সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা ফিরিয়ে আনার জন্য।
ট্রাম্পের মুখপাত্র স্টিভেন চেউং এটাকে আইনের শাসনের জন্য বিরাট বিজয় বলে বর্ণনা করেন।
ট্রাম্প চারটি ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয়েছিলেন – স্মিথের দায়ের করা দুটো মামলা, এবং নিউ ইয়র্ক আর জর্জিয়ার রাজ্য আদালতে দায়ের করা দুটো মামলা। নিউইয়র্ক মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন আর জর্জিয়ার মামলাটা ঝুলে আছে।
সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা এক মন্তব্যে ট্রাম্প সোমবার তার বিরুদ্ধে আনা মামলার তীব্র নিন্দা করে মামলাগুলোকে আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় বলে বর্ণনা করেন।
স্মিথকে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনেরাল মেরিক গারল্যান্ড নিয়োগ করেছিলেন। স্পেশাল কাউন্সেল হিসেবে স্মিথ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দুটি পৃথক মামলায় অভিযোগ গঠন করেন যেখানে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলার অভিযোগ আনেন। স্মিথের এই পদক্ষেপ তাই একটি অসাধারণ পথ-বদল।
নজিরবিহীন বিব্রতকর পরিস্থিতি
প্রসিকিউটররা স্বীকার করেন, চলমান ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি একজন প্রেসিডেন্টের নির্বাচন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টেকে নজিরবিহীন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
এখানে দেখা যাচ্ছে, ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় শুধু রাজনৈতিক জয় ছিল না, তা একটি আইনগত বিজয়ও ছিল।
ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে তার পরাজয়ের পর ট্রাম্প ভোট সংগ্রহ এবং সার্টিফাই করার প্রক্রিয়া ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে তার বিরুদ্ধে আনা চারটি ফেডেরাল অভিযোগ তিনি ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে অস্বীকার করেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প আবার জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের উপর তদারকি করবেন এবং ধারণা করা হচ্ছিল তিনি ২০২০ নির্বাচন সংক্রান্ত ফেডেরাল মামলা তুলে নেওয়ার আদেশ দেবেন।
গোপনীয় দলিল সংক্রান্ত মামলা ফ্লোরিডার বিচারক আইলিন ক্যানন জুলাই মাসে বাতিল করেছিলেন। স্মিথ-এর দফতর জাজ ক্যাননের রুলিং-এর বিরুদ্ধে আপিল করে। তারা সোমবার ইঙ্গিত দেয় যে আপিলের যে অংশ ট্রাম্পের দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে প্রযোজ্য, সেগুলো তারা চালিয়ে যাবেন।
গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এক রায় দেয়, হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন তারা কাজ সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেগুলোর জন্য প্রেসিডেন্টের দায় মুক্তি আছে।
ট্রাম্পের আইনজীবীরা আগে বলেছিলেন, তারা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বাতিল করার চেষ্টা করবেন।
তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে
Leave a Reply