জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ ক্রমেই এক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে যে পরিস্থিতি ‘হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার একেবারে শীর্ষে থাকতে থাকা বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, যার ফলাফল শুধুমাত্র পরিবেশের ক্ষতি নয়, বরং দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্যও ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি করছে। আজ ১৬ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে তাপের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রধান উপদেষ্ঠার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দুর রহমান। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার মিস ইফফাত মাহমুদ ও স্বাস্থ্যের Field Expert ওয়ামেকের সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডা. আ. রাজা।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি অনুভূত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা জনজীবনের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দশকের সবচেয়ে গরম বছর ছিল, যেখানে পয়েন্টে পয়েন্টে তাপমাত্রা আগের তুলনায় ব্যাপক বৃ্দ্ধি পেয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ১৯৮০ থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৪ ডিগ্রি, যা দেশের গড়ের তুলনায় অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বৃক্ষনিধন এবং কংক্রিটের অর্ধেক বাড়তি ব্যবহার ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে শহরগুলো আজ ভয়াবহ তাপপ্রবাহের শিকার। এর ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় দেহের স্বাভাবিক কার্যকলাপ ব্যাহত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গরমের প্রভাবে শারীরিক ও মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। দীর্ঘস্থায়ী কাশি, শীতের তুলনায় গরমে আরও বেশি দেখা যাচ্ছে। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় এসব রোগের ঝুঁকি ২২.৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গরমের সময় তাপজনিত ক্লান্তি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের প্রকোপও বেড়ে যাচ্ছে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপে এসব ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ হয়। নারী ও ৫ বছরের নিচের শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও তাপপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। গ্রীষ্মে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের হার শীতের চেয়ে বেশি। গরমের কারণে বিষণ্ণতা ২৩.৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে, উদ্বেগের হার বাড়ে ৩৭.১ শতাংশ।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতি হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ২০২৪ সালে তাপপ্রবাহের কারণে দেশের কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা মূল্যের। এর আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১.৩৩ থেকে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত, যা দেশের মোট জিডিপির শতকরা ০.৩ থেকে ০.৪ ভাগের সমান। বিশ্লেষকদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই ক্ষতি ৪.৯ শতকরা হারে বৃদ্ধি পেয়ে জিডিপির বড় অংশে পৌঁছে যাবে।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেই যেতে পারে যদি দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়। প্রতিবেদনটি পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রদান করেছে, যার মধ্যে রয়েছে:
১. জাতীয় প্রস্তুতি ও সমন্বিত পদক্ষেপ জোরদার করা,
২. স্বাস্থ্যসেবা প্রস্তুত ও গরমের জন্য বিশেষ জরুরি ব্যবস্থা,
৩. গরম মোকাবিলায় প্রযুক্তি ও সহনশীল আবাসন ব্যবস্থা ব্যবহার,
৪. আবহাওয়া তথ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সতর্কতা সিস্টেম চালু,
৫. জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য ও অর্থায়ন সংগ্রহ।
বিশ্বব্যাপী এই তাপপ্রবাহ এখন শুধু দেশের ব্যাপার নয়, বরং এটি এখন একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি সংকট। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। নগর পরিকল্পনা, সবুজায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও নীতিমালা আরও গুরুত্ব দিতে হবে ত্বরণে। রাজনীতিবীদ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি একযোগে কাজ করে তাহলে এই ভয়াবহ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।
Leave a Reply